২৬/১২/২০১৮ মহান বৈষ্ণব আচার্য শ্রীল ভক্তিসিদ্ধান্ত সরস্বতী ঠাকুরের তিরোধান তিথিতে গৌড়িয় সিংহপুরুষখ্যাত এই মহান আচার্যের জীবনী জানার জন্য পড়ুন নিচের বিশেষ লেখাটি শ্রীচৈতন্য মহাপ্রভু যৌবনে মাত্র ৪৮ বছর বয়সে জগত থেকে অন্তর্হিত হন।
যদিও তাঁর পার্ষদ এবং দৃঢ়চেতা পরম্পরা আচার্যগণ, মহান বৈষ্ণবগণ এই অভিযান
এগিয়ে নিয়ে গেছেন, কিন্তু একসময় কিছুকাল পরে মহাপ্রভুর সংকীর্তন আন্দোলন
অন্তর্হিত হয়। মহাপ্রভুর শিক্ষা, মহাপ্রভুর নিদের্শনা এবং মহাপ্রভুর ধাম
এই জগৎ থেকে অন্তর্হিত হয় এবং তদস্থলে সকল অপসম্প্রদায় গুলো আবির্ভূত
হয়ে এমন শিক্ষার বিস্তার ঘটালো যা সম্পূর্ণরূপে মহাপ্রভুর শিক্ষার বিপরীত।
শ্রীচৈতন্য মহাপ্রভুর শিক্ষা সম্পূর্ণরূপে পবিত্র ধর্মের নীতির ভিত্তিতে
গঠিত, কিন্তু তাদের সেই ক্রিয়াকর্মগুলো ছিল সম্পূর্ণ অধার্মিক।
এটি কলিযুগের আরেকটি চরিত্র। এই যুগ অধর্মের, তাই অধর্মীয় নীতিসমূহের ব্যাপক প্রসার ঘটবে এবং ধার্মিক নীতিসমূহ উপেক্ষিত হবে। শ্রীচৈতন্য মহাপ্রভুর অন্তর্ধানের পরে তা ঘটেছিল। অল্পকথায় বলতে গেলে, তাঁরা চৈতন্য মহাপ্রভুর নামে ধর্মের স্তম্ভস্বরূপ ৪টি বিধিনিষেধ ভঙ্গ করছিল। শ্রীচৈতন্য মহাপ্রভুর শিক্ষায় অধর্মের চারটি পা প্রবেশ করিয়ে ছদ্মভাবে উপস্থাপনা করা হল এবং তাঁরা সম্পূর্ণরূপে নিরামিষ খাদ্য গ্রহণ নীতি পরিত্যাগ করে, নেশায় মগ্ন থেকে , অবৈধ যৌনসঙ্গ এবং দ্যূতক্রিয়ায় লিপ্ত হল। প্রকৃত শিক্ষার পরিবর্তে অপশিক্ষার প্রাদুর্ভাব বেড়েই চলল। এগুলোই অপসম্প্রদায়ের চারিত্রিক বৈশিষ্ঠ। ক্ষুদ্রতর কিংবা বৃহত্তর মাত্রায় তারা ভক্তিযোগের প্রসারের পরিবর্তে নির্বিশেষ মায়াবাদী ভাষ্য প্রচার করছে। এই প্রচার প্রায় দুই শত বছর যাবৎ চলছে। ভারতবর্ষ পুরোপুরি এইসকল অপসম্প্রদায়ের খপ্পরে পতিত হয়েছে। ভারতবর্ষের বাইরে অপসম্প্রদায়গুলোর প্রদুর্ভাব তেমন বেশি নয়, কিন্তু শ্রীচৈতন্য মহাপ্রভুর লীলাবিলাস স্থান মায়াপুর, নবদ্বীপ এবং বৃন্দাবনে মহাপ্রভুর নামে এইসব অপকর্মের প্রাদুর্ভাব প্রচন্ডভাবে বেড়েই চলেছে।
তারপর শ্রীচৈতন্য মহাপ্রভু এইসব অপচেষ্টা নাশ করার ব্যবস্থা গ্রহণ করলেন। তিনি বৃন্দাবনে তাঁর অন্যতম পার্ষদ, একজন মঞ্জরী, শ্রীল ভক্তিবিনোদ ঠাকুরকে পাঠালেন। এরপর তিনি তাঁর পুত্ররূপে শ্রীল ভক্তিসিদ্ধান্ত সরস্বতী ঠাকুরকে পাঠানোর ব্যবস্থা গ্রহণ করলেন। ভক্তিবিনোদ ঠাকুর শ্রীচৈতন্য মহাপ্রভুর শিক্ষার পুনঃস্থাপন করলেন। তিনিই একমাত্র ব্যক্তি যিনি শ্রীচৈতন্য মহাপ্রভুর শিক্ষাকে অঝোরে প্রসারিত করলেন গ্রন্থ প্রকাশনার মাধ্যমে। তিনি শ্রীচৈতন্য মহাপ্রভুর শিক্ষার গভীর, মহিমান্বিত এবং সম্পূর্ণ নিষ্কলুষ ব্যাখ্যা প্রদান করলেন। তিনি ছিলেন একজন সরকারী কর্মকর্তা। তাঁর সময়গুলো যাতে শুধুমাত্র সরকারী কাজের কারণে ব্যবহৃত না হয় তা তিনি সেই প্রচেষ্ঠা করতেন। যদিও তার বিন্দুমাত্র সময় ছিল না। তিনি একাকী হয়তোবা কৃষ্ণভাবনামৃত, শ্রীচৈতন্য মহাপ্রভুর শিক্ষা কার্যকরীভাবে প্রতিষ্ঠা করতে পারতেন না। তাই তিনি ভগবান জগন্নাথের নিকট প্রার্থনা করলেন একজন যোগ্য সঙ্গি প্রেরণের উদ্দেশ্য। তাঁর প্রার্থনার ফলে ভগবান জগন্নাথের প্রসাদরূপে বা কৃপারূপে শ্রীল ভক্তিসিদ্ধান্ত সরস্বতী ঠাকুর আবির্ভূত হন। ভক্তিবিনোদ ঠাকুর তাঁর নাম রাখলেন বিমলাপ্রসাদ; বিমলা দেবীর প্রসাদ। বিমলা দেবীর প্রসাদ মূলত ভগবান জগন্নাথের প্রসাদ কেননা জগন্নাথের প্রসাদ অন্নপূর্ণা তথা বিমলা দেবীকে অর্পন করা হয়।
ভক্তিসিদ্ধান্ত সরস্বতী ঠাকুর স্বভাবতই অত্যন্ত মেধাবী ব্যক্তিত্ব ছিলেন। তিনি কোন সাধারণ ব্যক্তি ছিলেন না। তিনি ছিলেন একজন শুদ্ধ ভক্ত। তিনি চিন্ময় জগত থেকে এসেছিলেন তাঁর পিতা শ্রীল ভক্তিবিনোদ ঠাকুররের প্রচারে সহায়তা করতে। ভক্তিবিনোদ ঠাকুর তাঁকে সুন্দরভাবে পরিচালিত করেন, প্রশিক্ষিত করেন এবং গড়ে তোলেন। যখন তাঁর বয়স মাত্র ৬ বছর তখন ভক্তিবিনোদ ঠাকুর তাঁকে নৃসিংহ মন্ত্র প্রদান করেন। যখন তার বয়স আট, তখন কূর্মদেবের পূজার্চনা পদ্ধতি শেখান, কূর্ম মন্ত্র প্রদান করেন। কেন তিনি তা করলেন তা বিস্তারিতভাবে আমি বলতে চায় না, কিন্তু সাধারণভাবে আমরা বুঝতে পারি যে ভক্তিবিঘœবিনাশক নৃসিংহদেব ভক্তিযুক্ত সেবার বিপরীতে উৎপন্ন সকল প্রতিবন্ধকতা বিনাশ করেন। তাই তিনি তাকে এই মন্ত্র দিলেন যেন তিনি ভক্তিপথের সকল বাধা দূর করতে পারেন।
তাই আমরা এমন একজন অসাধারণ ব্যক্তিত্বকে অবলোকন করতে পারি। তিনি ১৮৭৪ সনে আবির্ভূত হন। ১৮৮৫ সনে তাঁর লিখিত গ্রন্থসমূহ প্রকাশনার জন্য একটি ছাপাখানা প্রতিষ্ঠা করেন। ১১ বছর বয়সে ভক্তিসিদ্ধান্ত সরস্বতী ঠাকুর তাঁর রচনাসমূহ সম্পাদনা করতেন। সেই ১১ বছর বয়সেই তিনি সম্পাদনা, ভুল সংশোধন এবং সেই অপ্রাকৃত গ্রন্থসমূহ ছাপানোর কাজে তাঁর পিতা ভক্তিবিনোদ ঠাকুরকে সাহায্য করতে শুরু করলেন। ১৯৮১ সনে ১৭ বছর বয়সে তিনি ‘‘দি অগাস্ট এ্যাসেম্বলী’’ নামক একটি সংগঠন প্রতিষ্ঠা করেন। অগাস্ট এ্যাসেম্বলীর উদ্দেশ্য ছিল তরুণ কিশোরদের একত্রিত করা যাতে তারা আজীবন ব্রহ্মচর্য অবলম্বন করতে পারে। সুতরাং আমরা দেখতে পাচ্ছি যে সেই অল্প বয়সেই তিনি অতি উচ্চতর ধারণার বশবর্তী ছিলেন। তিনি সেই ব্রহ্মচারীদের সমাবেশ তথা অগাস্ট এ্যাসেম্বলী শুরু করেছিলেন কিন্তু কেবলমাত্র একজনই সমগ্রজীবন ব্রহ্মচর্য পালনের প্রতিজ্ঞা পালনে সক্ষম হয়েছিলেন, তিনি হলেন ভক্তিসিদ্ধান্ত সরস্বতী ঠাকুর। ১৭ বছর বয়সে অগাস্ট এ্যাসেম্বলী প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে তিনি ব্রহ্মচর্য ব্রত পালনের যে সংকল্প করেছিলেন তা তিনি সমগ্রজীবনব্যাপি পালন করেছিলেন।
এরপর সেই বছরই, বাস্তবিকপক্ষে তার পরের বছরই ভক্তিবিনোদ ঠাকুর “সেবানন্দ সুখদা কুঞ্জ” প্রতিষ্ঠা করেন যা ছিল তাঁর বাসস্থান এবং ভজন কুঠির। এটি ছিল অত্যন্ত সুন্দর আবাসগৃহ। ১৮৯৮ সনে ভক্তিসিদ্ধান্ত সরস্বতী ঠাকুর শ্রীল গৌরকিশোর দাস বাবাজী মহারাজের সাক্ষাৎ লাভ করেন। তিনি তাঁর অসাধারণ ব্যক্তিত্বে আকৃষ্ট হন। ১৯০০ সনে বহু প্রচেষ্টা এবং অনেক বাধারপরীক্ষা অতিক্রম করে তিনি শ্রীল গৌরকিশোর দাস বাবাজী মহারাজের নিকট দীক্ষা প্রাপ্ত হন।
গৌর কিশোর দাস বাবাজী কোন শিষ্য গ্রহণ করতে চাননি। কিন্তু শ্রীল ভক্তিসিদ্ধান্ত সরস্বতী ঠাকুর তাকে দীক্ষা প্রদান করতে বাধ্য করেছিলেন। ১৯০৫ তিনি শতকোটি হরিনাম জপের আরেকটি মহা সংকল্প গ্রহণ করেন। শত কোটি নাম যজ্ঞ। সে যজ্ঞ সম্পাদন কল্পে তাকে তিন লক্ষ নাম জপ করতে হয়েছিল। অর্থাৎ তাকে দশ বছর পর্যন্ত প্রতিদিন অন্তত ৬৪*৩ = ১৯২ মালা জপ করতে হয়েছিল। সেসময় মায়াপুরে কিছুই ছল না, তার নাম জপের যে সংকল্প তিনি এই মায়াপুরেই সম্পাদন করতে চেয়েছিলেন। তখন এখানে কিছুই ছিল না। তিনি গঙ্গার তীরে একটি ছোট্ট কুঠিরে থাকতেন। বর্ষার সময় যখন বৃষ্টি হতো তখন সেখানে জল চুয়ে চুয়ে পড়ত অথবা ছাদ বেয়ে ভেতরে জল গড়িয়ে পড়ত। তিনি একটি ছাতা নিয়ে বসে থাকতেন এবং হরিনাম জপ করতেন। এ থেকে আমরা উপলব্দি করতে পারি যে তিনি কত দৃঢ় ব্যক্তিত্বের অধিকারী ছিলেন। তারপর ১৯১৮ সাল থেকে, তিনি তার প্রচারের মিশন শুরু করেন। তিনি সিদ্ধান্ত নেন নবদ্বীপের মায়াপুরে থেকে যাবেন এবং কলকাতায় গিয়ে প্রচার শুরু করবেন, কেননা শ্রীচৈতন্য মহাপ্রভু তাকে পাঠিয়েছিলেন সারাবিশ্বকে কৃষ্ণভাবনার জোয়ারে প্লাবিত করতে। তিনি কলকাতা গিয়েছিলেন, আমি শুনেছি যে, যখন তিনি কলকাতা যাওয়ার ইচ্ছা পোষন করেন, তখন গৌর কিশোর দাস বাবাজী মহারাজ কিছুটা উদ্বিগ্ন হন। তিনি বলেছিলেন, “না, কলকাতায় যেও না, সেটি কলির আস্থানা।’ তখন ভক্তিসিদ্ধান্ত সরস্বতী ঠাকুর বলেছিলেন, “আপনার শ্রী পাদপদ্ম আমার মস্তকে ধারণ করে, আমি কলির যে কোনো আক্রমণ প্রতিহত করতে পারব এবং এভাবে তিনি কলি বা কলির প্রভাবকে সম্পূর্ণরূপে বিনাশ করব।” এভাবে তিনি তার প্রচার মিশনে অগ্রসর হয়েছিলেন। ইতোমধ্যে, গৌরকিশোর দাস বাবাজী মহারাজ এবং ভক্তিবিনোদ ঠাকুর উভয়ই প্রকট হলেন, ভক্তবিনোদ ঠাকুর অপ্রকট হন ১৯১৪ সালে এবং গৌরকিশোর দাস বাবাজী মহারাজ অপ্রকট হন ১৯১৫ সালে ১৯১৮ সালে, শ্রীল ভক্তিসিদ্ধান্ত সরস্বতী ঠাকুর তার প্রচার আন্দোলন শুরু করেন। তিনি কলকাতায় যান। আপনারা সবাই জানেন যে, তার প্রথম মঠ বা প্রচার কেন্দ্র স্থাপিত হয় এক উল্টোদঙ্গ প্রধান সড়কে। যেখানে শ্রীল প্রভুপাদ ১৯২২ সালে তার সাথে সাক্ষাত করেছিলেন। সেসময় ভক্তিসিদ্ধান্ত সরস্বতী ঠাকুর শ্রীল প্রভুপাদকে তার প্রথম নির্দেশ প্রদানের মাধ্যমে উজ্জীবিত করেছিলেন। “শ্রীচৈতন্য মহাপ্রভুর শিক্ষা ইংরেজি ভাষায় সারাবিশ্বে প্রচার কর”, এই ছিল তার নির্দেশ। তখন প্রভুপাদের বয়স ছিল ২৬ বছর। তিনি ছিলেন একজন গৃহস্থ এবং তার একটি পুত্র সন্তান ছিল। কিন্তু এখানেও আমরা আরেকটি উল্লেখযোগ্য দৃষ্টান্ত লক্ষ্য করব। প্রথম সাক্ষাতে দেওয়া তার প্রথম নির্দেশেই শ্রীল প্রভুপাদের সমগ্র জীবনের আমূল পরিবর্তন ঘটে যায়। শ্রীল প্রভুপাদ তার চাকুরী এবং অন্যান্য কর্তব্য পরিত্যাগ করে। সারা বিশ্বে কৃষ্ণভাবনামৃত প্রচারে ব্রতী হন। যদিও দৃশ্যত প্রভুপাদ সে সময় তার ব্যবসা চালিয়ে যান, কিন্তু তা সত্ত্বেও তার হৃদয় ছিল শ্রীচৈতন্য মহাপ্রভুর শিক্ষা প্রচারের জন্য দৃঢ় সংকল্পবদ্ধ। ভক্তিসিদ্ধান্ত সরস্বতী ঠাকুর এভাবে ১৯১৮ সালে তার প্রচার মিশন শুরু করেছিলেন। তিনি ১৯১৩ সাল পর্যন্ত খুব সুন্দরভাবে কৃষ্ণভাবনা প্রচার করেন। ভারতজুড়ে তিনি প্রতিষ্ঠা করেন ৬৪টি মঠ এবং সে সময়ের কাছ গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিদের তিনি প্রভাবিত করেন। তিনি তাদেরকে আকর্ষন করতেন। তিনি কৃষ্ণভাবনা প্রচারের এক বিশেষ ও অদ্বিতীয় পন্থার সূচনা করেছিলেন। কৃষ্ণভাবনামৃত প্রচারের এই নীল নকশাটি প্রদান করেছিলেন ভক্তিবিনোদ ঠাকুর। প্রচার আন্দোলনের ক্ষেত্রে শ্রীচৈতন্য মহাপ্রভুর মূল লক্ষ্যটি ছিল: কৃষ্ণভাবনাকে প্রতিষ্ঠা করা এবং এই কলিযুগে অধর্মের প্রভাব চিরতরে নির্মূল করা। অতএব আমরা দেখি যে, ভক্তিসিদ্ধান্ত সরস্বতী ঠাকুর সংকীর্তন আন্দোলনের ক্ষেত্রে একটি ভিন্ন মাত্রা সংযোজন করেছিলেন। সাধারণভাবে সংকীর্তনের অর্থ হল সম্মিলিত কীর্তন। কিন্তু এখানে তার সংকীর্তন আন্দোলন মানে ছিল গ্রন্থ ছাপানো এবং বিতরণ। এই সংর্কীন আন্দোলনে মৃদঙ্গ হল বৃহৎমৃদঙ্গ। কৃষ্ণভাবনা প্রচারের ক্ষেত্রে তার সংযোজিত এই নতুন মাত্রাটি ছিল অদ্বিতীয়। শুধু তাই নয়, তিনি আরেকটি অত্যন্ত অদ্বিতীয় একটি মাত্রা প্রদান করে গেছেন। প্রথমদিকে তিনি উল্টাদঙ্গ প্রধান সড়কে একটি দো-তলা ঘরে থাকতেন। তখন কিছু ধনী লোক তার প্রচারে আকর্ষিত হয়ে নিজেদেরকে তার কাছে উৎসর্গ করেছিলেন। তাদের একজন বাঘ বাজারে একটি বড় মন্দির তৈরি করেন। তাই তিনি উল্টাদঙ্গ থেকে বাঘ বাজার গৌড়িয় মঠে প্রস্থান করেন সেখানে বিগ্রহ অভিষেকের সময় তিনি একটি গান গেয়েছিলেন। গানটি ছিল এরকম : পুজালা রাগ-পঠ গৌরব ভঙ্গে মতাাল সাধু-জন বিশ্ব-রঙ্গে। ‘গৌরব’ অর্থ শ্রদ্ধা এবং ভক্তি। ‘গৌরব ভঙ্গে’ অর্থ শ্রদ্ধা ও ভক্তির এই পন্থা পরিত্যাগ করে রাগ-মার্গ গ্রহণ করা। রাগ-মার্গ পূজিত এবং প্রতিষ্ঠিত। তার ফল সাধু ব্যক্তিদান বিশ্ব রঙ্গে যিুক্ত হয়েছেন। যা দৃশ্যত জড় কার্যকলাপ বলে প্রতিভাত হয়। অতএব ‘এই হল শ্রীল ভক্তিসিদ্ধান্ত সরস্বতী ঠাকুরের আন্দোলনের তেজদীপ্ততা, সাধুরা দৃশ্যত জড় কার্যকলাপে নিযুক্ত হয়েছেন, তবে সেসময় সেই সারভাবটি কি ছিল যা ভক্তিসিদ্ধান্ত সরস্বতী ঠাকুর প্রতিষ্ঠা করে গেছেন? সেটি হল পুজালা রাগ পট। এই হল শ্রীচৈতন্য মহাপ্রভুর প্রকৃত তেজদীপ্ততা। মাঝে মাঝে আমরা দেখি যে, লোকেরা রাগানুগ ভক্তির কথা বলে এবং দাবি করে যে, শ্রীল প্রভুপাদ সেই রাগানুগ ভক্তিটি প্রদান করেননি। তাই তারা বলে, ইস্কন ভক্তদের উচিত ইস্কন পরিত্যাগ করে রাগানুগভক্তি অনুশীলন করা। চলুন আমরা এবার দেখি রাগানুগ ভক্তি কি রাগানুগ ভক্তির সংজ্ঞা হল, বৃন্দাবনে রাগাত্মিকা ভক্তদের অনুসরণ করা, যারা সম্পূর্ণরূপে কৃষ্ণের প্রতি গভীর প্রেমময়ী আসক্তিতে নিমগ্ন। ব্রজে কৃষ্ণের অনুসারীরা হলেন রাগাত্মিকা ভক্ত। যখন কেউ তাদের পদাঙ্ক অনুসরণ করে ভক্তিমূলক সেবা অনুশীলন করেন, তখন সেটিকে বলা হয় রাগানুগ। অতএব, সহজ অর্থে ব্রজকৃষ্ণের একজন অনুসারী অনুসরণ করার নামই হল রাগানুগ ভক্তি। এখন প্রশ্ন হল, ব্রজে কৃষ্ণের সর্বশ্রেষ্ঠ অনুসারী কে? তিনি হলেন শ্রীমতি রাধারানি। তবে শ্রীচৈতন্য মহাপ্রভু কে? চৈতন্য মহাপ্রভু হলেন কৃষ্ণ যিনি শ্রীমতি রাধারানির ভাবে অধিষ্ঠিত। চৈতন্য মহাপ্রভুর কার্যকলাপ হল শ্রীমতি রাধারানির কার্যকলাপ। যারা শ্রীমতি রাধারানির পদাঙ্ক অনুসরণ করছেন, তারা কোন প্রকার ভক্ত? তারা হলেন রাগানুগ ভক্ত। তবে শ্রীচৈতন্য মহাপ্রভুর শিক্ষা কি? যারে দেখ, তারে কহ ‘কৃষ্ণ’ উপদেশ আমার আজ্ঞায় গুরু হঞা তার এই দেশ যাকেই দেখ তাকেই কৃষ্ণভাবনা প্রচার কর, কৃষ্ণ এবং তার শিক্ষা সম্পর্কে শিক্ষা দাও। অতএব, প্রচারই হল শ্রীচৈতন্য মহাপ্রভুর শিক্ষা, এটিই হল চৈতন্য মহাপ্রভুর ভাব। তিনি স্বয়ং বারতের সর্বত্র ভ্রমণ করে কৃষ্ণভাবনামৃত বিতরণ করে গেছেন। তাই চৈতন্য মহাপ্রভুর পদাঙ্ক অনুসরণ করাই হল রাগানুগ ভক্তি। ভক্তিসিদ্ধান্ত সরস্বতী ঠাকুর বলেছেন যে, সাধুরা দৃশ্যত জড় কার্যকলাপে যুক্ত হলেও সেই কার্যকলাপসমূহ প্রকৃতপক্ষে কি? এ সমস্ত কার্যকলাপের উদ্দেশ্যই হল সারাবিশ্বে কৃষ্ণভাবনাকে ছড়িয়ে দেওয়া। আমরা দেখতে পাই যে, এই ভাবটি খুব সুন্দরভাবে বহন করেছিলেন শ্রীল প্রভুপাদ।
শ্রীল প্রভুপাদের ভাবটি ছিল এমন যে, কৃষ্ণভাবনা প্রচারের নিমিত্তে আমাকে যাই করতে হয় আমি তাই করতে প্রস্তুত। আমি যেকোন কিছুকে নিয়োজিত করতে প্রস্তুত। শ্রীল প্রভুপাদ কৃষ্ণভাবনা প্রচারের উদ্দেশ্য মাইক্রোফোন, টেলিফোন, টেপ রেকর্ডার, কম্পিউটার, এরোপ্ল্যান সহ আরো অনেককিছুকে নিয়োজিত করেছিলেন। প্রভুপাদ এমনকি বলেছিলেন যে, যদি প্রয়োজন হয় কৃষ্ণভাবনা বিস্তৃত করার জন্য আমরা পারমানবিক বোমা পর্যন্ত ব্যবহার করতে প্রস্তুত (হাসি !)।
অবশ্যই এমনকি এটম বোমার মত একটি উপকরণ ব্যবহার করতেও আমাদের শ্রীল প্রভুপাদের মত একজন ব্যক্তিত্বের প্রয়োজন। শুধু তার মতই একজন ব্যক্তিত্ব অথবা তার সমমানের একজন ব্যক্তিই এটি করতে পারেন।
এভাবে শ্রীল ভক্তিসিদ্ধান্ত সরস্বতী ঠাকুর, মহাপ্রভুর সংকীর্তন আন্দোলনের প্রকৃত উদ্দেশ্যটি প্রতিষ্ঠা করে গেছেন এবং অত্যন্ত যথাযথভাবে শ্রীল প্রভুপাদ সেটিকে বহন করেছিলেন এবং সারাবিশ্বে তা প্রতিষ্ঠা করেছিলেন। যদি কেউ বলে যে, শ্রীল ভক্তিসিদ্ধান্ত সরস্বতী ঠাকুরের গৌড়িয় মঠ থেকে ইস্কন ভিন্ন, তবে আমি বলব তারা প্রকৃতপক্ষে ভুল করছেন। পক্ষান্তরে, আমি বলব গৌড়িয়মঠের ধ্বংস হওয়া থেকে শ্রীল প্রভুপাদই আন্তর্জাতিক কৃষ্ণভাবনামৃত সংঘ (ইস্কন) গঠনের মাধ্যমে শ্রীল ভক্তিসিদ্ধান্ত সরস্বতী ঠাকুরের সেই চেতনার পূর্ণজাগরণ ঘটান।
শ্রীল ভক্তিসিদ্ধান্ত সরস্বতী ঠাকুর কি জয় !
শ্রীল ভক্তিসিদ্ধান্ত সরস্বতী ঠাকুরের তিরোভাব তিথি মহোৎসব কি জয় !
প্রবক্তা :- শ্রীমৎ ভক্তিচারু স্বামী মহারাজ
স্থানঃ শ্রীমায়াপুর ধাম, ব্যাসপুজা ২০১৫
মন্তব্যসমূহ