সরাসরি প্রধান সামগ্রীতে চলে যান

শ্রীচৈতন্য মহাপ্রভু ও রামানন্দ রায় সংবাদ

 শ্ৰীরামানন্দ রায় রাজা শ্ৰী প্ৰতাপরুদ্রের অধীন পূৰ্ব্ব ও পশ্চিম গোদাবরীর বিশ্বস্ত শাসন কৰ্ত্তার পদে অধিষ্ঠিত ছিলেন। চৈতন্য মহাপ্ৰভু যখন দক্ষিণ দেশে যাত্ৰা করেন, শ্ৰীসাৰ্বভৌম আচার্য্য বিশেষ অনুরোধ করেন মহাপ্রভু যেন শ্ৰীরামানন্দ রায়ের সঙ্গে মিলিত হন ।



“তোমার সঙ্গে যোগ্য তেঁহো একজন,

পৃথিবীতে রসিক ভক্ত নাহি তার সম''।।চৈঃচঃ মধ্যঃ

শ্রীচৈতন্য মহাপ্ৰভু দক্ষিণ দেশ অভিমুখে যাত্ৰা করেন। হরিনামের প্রেম বিতরণ করতে করতে এলেন পশ্চিম গোদাবরীর তীরে । পন্ডিত সাৰ্ব্বভৌমের অনুরোধ অনুযায়ী শ্ৰীরামানন্দ রায়ের সঙ্গে মিলিত হবার ইচ্ছা মহাপ্ৰভুর মনে সদা জাগ্রত ছিল । শ্ৰীমহাপ্ৰভু গোদাবরীর মনোহর তটে এক বৃক্ষমূলে বসে আছেন । তার অঙ্গ কান্তিতে চতুৰ্দ্দিক যেন আলোকিত হচ্ছিল । এমন সময় অনতিদূরে রাজপথ দিয়ে স্নান করতে যাচ্ছেন শ্ৰীরামানন্দ রায়, সাথে বৈদিক ব্ৰাহ্মণগনের বিবিধ বাজনা । শ্ৰীরামানন্দ রায় দূর থেকে উপবিষ্ট বৃক্ষমুলে কান্তিযুক্ত সন্ন্যাসীবরকে একদৃষ্টিতে দৰ্শন করতে লাগলেন এবং মহাপ্ৰভুও তঁকে অপলক নেত্ৰে দেখতে লাগলেন । নয়নে নয়নে হল মিলন । তারপর শ্ৰীরামানন্দ পালকি থেকে নেমে শ্ৰীমহাপ্ৰভুর চরনে দন্ডবৎ করলেন । মহাপ্ৰভু রামানন্দ রায়কে ভূমি থেকে তুলে আলিঙ্গন করে, জিজ্ঞাসা করলেন, ''কে তুমি ?
রামানন্দ রায় বললে, ''হা প্ৰভো ! আমি সেই শূদ্ৰাধম'' । মহাপ্ৰভু গাঢ় আলিঙ্গন করলেন। বললেন —
''আমার এতদূরে আসবার উদ্দেশ্য সিদ্ধ হল''।
'' হাঁ প্ৰভো !
এ অধম শূদ্রের প্রতি এত দয়া কেন''? রায় বলেন।
প্রভু বলেন, ''পুরীতে পন্ডিত সাৰ্ব্বভৌমের নিকট তোমার মহিমা শুনেছি । তোমার মত রসিক ভক্ত দ্বিতীয় নাই''।
রায় বলেন, ''আমায় এত কৃপা করলেন কেন ? বোধহয় আপনি তাকে কুতৰ্কগৰ্ত্ত থেকে উদ্ধার করে প্ৰেমরসসুধা পান করিয়েছেন''। রামানন্দ রায় আবার প্রভুর চরণ ধারণ করলেন,প্ৰভু আলিঙ্গন করলেন । উভয়ের অঙ্গে অষ্ট সাত্তিক বিকার সমূহ প্ৰকাশ পেতে লাগল। বৈদিক ব্ৰাহ্মণগণ অবাক হয়ে চেয়ে রইলেন । শূদ্র রাজাকে স্পৰ্শ করে সন্ন্যাসী এত প্ৰেমযুক্ত হয়ে পড়লেন কেন ?
বাহ্যতঃ শ্ৰীরামানন্দ রায় যে, এমন মহান ভক্ত তা কেউ জানত না ।
ব্ৰাহ্মণগণের মন জেনে মহাপ্ৰভু ধৈৰ্য ধারণ করলেন ।
রামানন্দ রায় বললেন — হে করুণাময় প্ৰভো ! যদি অধমকে কৃপা করবার জন্য আগমন করে থাকেন , আট দশ দিন এখানে অবস্থান করে এ দীনকে উদ্ধার করুন''।মহাপ্রভু রায়ের কথা রাখলেন।তারপর দুজনে প্রেমানন্দে মত্ত হয়ে কৃষ্ণকথা শুরু করলেন। মহাপ্ৰভু প্ৰশ্ন করতে লাগলেন এবং রামানন্দ রায় তার উত্তর দিতে লাগলেন।
দুজনে ধীরে ধীরে ভাবের অন্তঃপুরে প্রবেশ করতে লাগলেন।
শ্রীচৈতন্য মহাপ্রভু বললেন, ''হে রায় কি সাধ্যের নির্নয়ে কৃষ্ণভক্তি হয়''?।
রায় কহে, ''প্রথমতঃ বর্নাশ্রম ধর্ম পালনে কৃষ্ণভক্তি হয়''।
তারপর কৃষ্ণ কর্মার্পন, নিস্কাম কর্ম, জ্ঞানমিশ্রা ভক্তি, জ্ঞানশুন্য ও শুদ্ধাভক্তির কথা বললেন। কিন্তু মহাপ্রভু সন্তুষ্ট হলেন না।
বললেন, ''রায় আগে কহ''। এরপর রায়, কৃষ্ণরতির দাস্য, সখ্য, বাৎসল্য ও মধুর রতিতে শ্রীমতি রাধাঠাকুরানীর অসাধারণ ভাবের কথা বললেন।
মহাপ্রভু সন্তুষ্ট হলেন কিন্তু বললেন,
''হে রায় আর কিছু বল ?
রামানন্দ রায় বলতে লাগলেন, ''শ্রীরাধাকৃষ্ণ মিলিত তনু ত আপনি, আপনি যা বলাচ্ছেন আমি তাই বলছি''।
''একেলা ঈশ্বর কৃষ্ণ আর সব ভৃত্য,
যারে যৈছে নাচায় সে তৈছে করে নৃত্য''।।
মহাপ্রভু রামানন্দ রায়ের মুখে হস্ত চাপা দিলেন। বললেন, ''আর বলতে হবে না, যথেষ্ট হয়েছে''। এরপর দুজনে ঘুমাতে গেলেন। পরদিবস সন্ধ্যাকালে পুনঃ শ্ৰীরামানন্দ রায় শ্ৰীমহাপ্ৰভুর চরণ - প্ৰান্তে এলেন ও দভবৎ করলেন । মহাপ্ৰভু উঠে গাঢ় প্রণয়সহ আলিঙ্গন করলেন । তারপর কথা আরম্ভ করলেন মহাপ্ৰভু প্ৰশ্ন করতে লাগলেন এবং রামানন্দ রায় তার উত্তর দিতে লাগলেন ।
প্রঃ বিদ্যামধ্যে কোন বিদ্যা শ্ৰেষ্ঠ ?
উত্তরঃ কৃষ্ণ - ভক্তিবিদ্যাই সৰ্ব্বশ্রেষ্ঠ ।
প্রঃ জীবের কীৰ্ত্তি কি ?
উঃ শ্ৰীকৃষ্ণদাস পদবীই সৰ্ব্বশ্রেষ্ঠকীৰ্ত্তি ।
প্রঃ জীবের পরম ধৰ্ম কি ?
উঃ শ্ৰীরাধাগোবিন্দের প্ৰেমই পরম ধৰ্ম ।
প্রঃ জীবের সকাপেক্ষা দুঃখ কি ?
উঃ কৃষ্ণ ভক্তের বিরহ দুঃখ ।
প্রঃ জীবের মধ্যে সৰ্ব্বশ্ৰেষ্ঠ মুক্ত কে ?
উঃ কৃষ্ণ - প্রেমিকই মুক্ত শিরোমণি ।
প্রঃ গানের মধ্যে কোন গান শ্ৰেষ্ঠ ?
উঃ রাধাগোবিন্দর লীলা গান ।
প্রঃ জীবের সর্বশ্ৰেষ্ঠ মঙ্গল কি ?
উঃ কৃষ্ণ ভক্তের সঙ্গ ।
প্ৰঃ । একমাত্ৰ স্মরণীয় কি ?
উঃ । কৃষ্ণের নাম , রুপ , গুণাদি ।
প্ৰঃ । জীবের একমাত্ৰ ধ্যান কি ?
উঃ । শ্ৰীরাধাগোবিন্দর পাদপদ্ম ।
প্ৰঃ । জীবের শ্ৰেষ্ঠ বাসস্থানকি ?
উঃ । শ্ৰীকৃষ্ণলীলাক্ষেত্ৰ ।
প্ৰঃ । জীবের শ্ৰেষ্ঠ শ্ৰবণের বিষয় কি ?
উঃ । শ্ৰীরাধা গোবিন্দর প্ৰেম লীলা ।
প্ৰঃ । জীবের একমাত্ৰ কীৰ্ত্তনীয় কি ?
উঃ । শ্ৰীরাধা গোবিন্দনাম ।
প্ৰঃ । বুভুক্ষু ও মুমুক্ষুর গতি কি ?
উঃ । স্থাবর দেহ ও দেব দেহ ।
প্ৰঃ । জ্ঞানী ও ভক্তের বৈশিষ্ট্য কি ?
উঃ । অরসজ্ঞ কাক জ্ঞান - নিম্ব - ফল খায় ,
রসজ্ঞ কোকিল ভক্ত প্রেমাস্রু - মুকুল-রস পান করেন। অতঃপর মহাপ্ৰভু রামানন্দ রায়কে রাধাকৃষ্ণ ও মহাপ্রভুর মহাভাব মিলিত স্বরুপ দেখালেন । তা দৰ্শনে রামানন্দ রায় মুর্ছিতা হয়ে পড়লেন । কিছুক্ষন পরে জ্ঞান পেয়ে চৈতন্য মহাপ্রভুর বিবিধ স্তবস্তুতি করতে লাগলেন । শ্রীচৈতন্য মহাপ্ৰভু রামানন্দ রায়কে এই রুপের কথা গোপন রাখতে বললেন ৷ মহাপ্ৰভু বিদায় চাইলে— রায় কেঁদে চরণ তলে লুটিয়ে পড়ে বলতে লাগলেন — ''তুমি স্বতন্ত্ৰ ঈশ্বর তোমার লীলা কে বুঝতে পারে ? একমাত্ৰ প্ৰাৰ্থনা দাসের দাস করে শ্ৰীচরনে সেবার সুযোগ প্ৰদান কর''।
মহাপ্ৰভু বললেন — ''তুমি বিষয় ত্যাগ করে নীলাচলে এস , তথায় দুজনে নিরন্তর কৃষ্ণ - কথা রসে দিন কাটাবো''।
এই বলে মহাপ্রভু দক্ষিন ভারতের বিভিন্ন স্থানে রওনা দিলেন।
রাজা রামানন্দ রায় ভিখারীর মত হাটু গেড়ে ভাষাহীন হয়ে কাঁদতে লাগলেন।
এই রামানন্দ রায় ও স্বরুপ দামোদর মহাপ্রভুর অন্তলীলার স্বাক্ষী।
'' রামানন্দের কৃষ্ণকথা স্বরুপের গান,
বিরহ-বেদনায় প্রভুর রাখয়ে প্রান''।। চৈতন্যচরিতামৃত
#শ্রীচৈতন্য মহাপ্রভু অপ্রকট হলে রামানন্দ রায় মহাপ্রভুর বিরহে কাতর হয়ে মাথায় আঘাত করতে করতে নিজেও এই ধরাধাম থেকে বিদায় নেন।। হরে কৃষ্ণ🙏🙏

মন্তব্যসমূহ

এই ব্লগটি থেকে জনপ্রিয় পোস্টগুলি

কৃষ্ণ কোন ভক্তকে কীভাবে সাহায্য করেন?????

  কৃষ্ণ কোন ভক্তকে কীভাবে সাহায্য করেন ? প্রশ্ন : আমার প্রশ্নটি খুব তুচ্ছ, কিন্তু তবুও আমি জানতে চাই কীভাবে কৃষ্ণ কোন ভক্তকে সাহায্য করেন? শ্রীল জয়প তাকা স্বামী গুরুমহারাজ: কৃষ্ণ বিভিন্ন উপায়ে একজন ভক্তকে সাহায্য করতে পারেন। আমরা তাঁর অনুগ্রহের পন্থাগুলিকে পরিমাপ করতে পারি না। যেমন ধরুন, একটি মজার গল্প আছে। একটি বড় বন্যাকবলিত এলাকায় এক লোক ছিল। সে তার ঘরে গিয়ে বলত, হে ভগবান! আমাকে এই বিশাল বন্যা থেকে উদ্ধার কর। আর তখন একটি নৌকা এল, সে বলল, না না, আমি চাই কেবল ভগবান এসে আমাকে উদ্ধার করবে। এরপর হেলিকপ্টার এল। না, না, আমাকে কেবল ভগবানই উদ্ধার করবে। এমনকি যখন কৃষ্ণ যখন নিজে সেই ব্যক্তির সামনে উপস্থিত হলেন, সে বলল, তুমি কেন আমাকে আগে বাঁচাওনি? তিনি বললেন, আমি একটি নৌকা পাঠালাম, একটি হেলিকপ্টার পাঠালাম, তুমি আর কী চাও? তো এভাবে তিনি বাহ্যিকভাবে বা অভ্যন্তরীণ উপায়ে সহায়তা করতে পারেন। গীতায় বলা আছে কৃষ্ণ জ্ঞান, স্মৃতি ও বিস্মৃতি দান করেন। সুতরাং তিনি আমাদের সংশয়ও নাশ করেন। ~শ্রীল জয়পতাকা স্বামী গুরুমহারাজ ২৪শে জুলাই, ২০১৮ চেন্নাই, ভারত

মহান বৈষ্ণব আচার্য শ্রীল ভক্তিসিদ্ধান্ত সরস্বতী ঠাকুরের তিরোধান তিথি

২৬/১২/২০১৮ মহান বৈষ্ণব আচার্য শ্রীল ভক্তিসিদ্ধান্ত সরস্বতী ঠাকুরের তিরোধান তিথিতে গৌড়িয় সিংহপুরুষখ্যাত এই মহান আচার্যের জীবনী জানার জন্য পড়ুন নিচের বিশেষ লেখাটি শ্রীচৈতন্য মহাপ্রভু যৌবনে মাত্র ৪৮ বছর বয়সে জগত থেকে অন্তর্হিত হন। যদিও তাঁর পার্ষদ এবং দৃঢ়চেতা পরম্পরা আচার্যগণ, মহান বৈষ্ণবগণ এই অভিযান এগিয়ে নিয়ে গেছেন, কিন্তু একসময় কিছুকাল পরে মহাপ্রভুর সংকীর্তন আন্দোলন অন্তর্হিত হয়। মহাপ্রভুর শিক্ষা, মহাপ্রভুর নিদের্শনা এবং মহাপ্রভুর ধাম এই জগৎ থেকে অন্তর্হিত হয় এবং তদস্থলে সকল অপসম্প্রদায় গুলো আবির্ভূত হয়ে এমন শিক্ষার বিস্তার ঘটালো যা সম্পূর্ণরূপে মহাপ্রভুর শিক্ষার বিপরীত। শ্রীচৈতন্য মহাপ্রভুর শিক্ষা সম্পূর্ণরূপে পবিত্র ধর্মের নীতির ভিত্তিতে গঠিত, কিন্তু তাদের সেই ক্রিয়াকর্মগুলো ছিল সম্পূর্ণ অধার্মিক। এটি কলিযুগের আরেকটি চরিত্র। এই যুগ অধর্মের, তাই অধর্মীয় নীতিসমূহের ব্যাপক প্রসার ঘটবে এবং ধার্মিক নীতিসমূহ উপেক্ষিত হবে। শ্রীচৈতন্য মহাপ্রভুর অন্তর্ধানের পরে তা ঘটেছিল। অল্পকথায় বলতে গেলে, তাঁরা চৈতন্য মহাপ্রভুর নামে ধর্মের স্তম্ভস্বরূপ ৪টি বিধিনিষেধ ভঙ্গ ...