সরাসরি প্রধান সামগ্রীতে চলে যান

রাস পূর্ণিমা তুলসি মহারানী ও শালগ্রাম এর বিবাহ তিথি।

শিবপুরাণ অনুসারে পুরাকালে দৈত্যদের রাজা ছিলেন দম্ভ| দম্ভ ছিলেন বিষ্ণুর উপাসক| দীর্ঘদিন পুত্রহীন থাকার পর তিনি স্থির করলেন ভগবান বিষ্ণুর তপস্যা করবেন পুত্রপ্রাপ্তির জন্য| যেমন ভাবা তেমনি কাজ| গুরু শুক্রাচার্যের কাছ থেকে শ্রী কৃষ্ণমন্ত্র নিয়ে পুস্করে গিয়ে ঘোর তপস্যায় রত হলেন| তাঁর তপস্যায় সন্তুষ্ট হয়ে শ্রীবিষ্ণু রাজা দম্ভকে পুত্রপ্রাপ্তির বর দান করলেন|

ভগবান বিষ্ণুর বরে যথাসময়ে রাজা দম্ভের ঘর আলো করে জন্মাল একটি পুত্র| পুত্রের নাম রাখা হল শঙ্খচুড়| এই শঙ্খচুড় ছিলেন ভগবান বিষ্ণুর অভিন্ন হৃদয় বন্ধু সুদামা যাকে শ্রীরাধা ক্রোধান্বিত হয়ে শাপ দিয়েছিলেন অসুরযোনিতে তার জন্ম হবে| শঙ্খচুড় ছিলেন উচ্চাকাঙ্খী পুরুষ| বয়ঃপ্রাপ্তির সাথে সাথেই অমিত ক্ষমতালাভের জন্য পুস্করিণীর মধ্যে গিয়ে ব্রহ্মার তপস্যায় রত হলেন| তার ঘোরতর তপস্যায় প্রসন্ন হয়ে ব্রহ্মা প্রকট হলেন এবং বর দিতে উদ্যত হলেন| শঙ্খচুড় কৃতাঞ্জলিতে প্রার্থনা করলেন তাকে দেবতাদের বিরুদ্ধে অজেয় হবার বর প্রদান করা হোক|
ব্রহ্মা মঞ্জুর করলেন প্রার্থনা আর তাকে নির্দেশ দিলেন বদরীবনে গিয়ে তপস্যারতা তুলসীকে বিবাহ করতে| ব্রহ্মার নির্দেশে শঙ্খচুড় বদরীবনে গিয়ে তপস্যারতা তুলসীকে দেখে তার রুপে আকৃষ্ট হলেন ও বিবাহের প্রস্তাব দিলেন| ব্রহ্মার পৌরহিত্যে গান্ধর্বমতে উভয়ের বিবাহ সুসম্পন্ন হল| তুলসী পূর্বজন্মে গণেশ কর্তৃক অভিশাপপ্রাপ্ত ছিল| সেই অভিশাপেই সে অসুররাজের ঘরণী হয়েছিল| সে গল্প অন্যত্র| শঙ্খচুড়ের সাথে সুখে জীবননির্বাহ করতে শুরু করল তুলসী|
শঙ্খচুড় ছিলেন বীর| উপরন্তু ব্রহ্মার বরে বলীয়ান হয়ে তিনি একের পর এক দেবতা‚ দানব‚ রাক্ষস‚ যক্ষ‚ নাগ‚ কিন্নর‚ মানব অর্থাৎ ত্রিলোকের সমস্ত প্রাণীর ওপর বিজয়প্রাপ্ত করলেন| দৈত্যকূলে জন্ম হলেও তিনি ছিলেন আজীবন বিষ্ণুর পদে নিবেদিতপ্রাণ| অত্যাচার তার চরিত্রে ছিল না| তাই তার শাসনাধীনে প্রজারা সকলেই ছিল সুখী|
এদিকে স্বর্গ থেকে বিতাড়িত হয়ে দেবতারা স্বর্গ ফিরে পেতে ব্রহ্মার দ্বারস্থ হলেন| কিন্তু ব্রহ্মা বরাবরই বর দিতে যত সিদ্ধহস্ত সেই বরদান হতে উদ্ভুত পরিস্থিতি মোকাবিলা করতে ততটা নন| তাকে বরাবরই শ্রী বিষ্ণুর দ্বারস্থ হতে হয় এইসব সমস্যা সমাধানে| অতএব তিনি দেবতাদের নিয়ে শ্রী বিষ্ণুর কাছে গেলেন| সব শুনে জগতপালক শ্রীবিষ্ণু বললেন‚ ভগবান শিবের ত্রিশুলে বিদ্ধ হয়েই শঙ্খচুড়ের মৃত্য ঘটবে| আপনারা ভাগবান শিবের দ্বারস্থ হন|
অতএব দেবতারা শিবের স্মরণাপন্ন হলেন| ভগবান শিব দেবতাদের মুখে সব শুনে চিত্ররথকে দূত বানিয়ে শঙ্খচুড়ের কাছে প্রেরণ করলেন| চিত্ররথ শঙ্খচুড়কে অনেক বোঝালো যাতে সে স্বর্গ দেবতাদের ফিরিয়ে দেয়| কিন্তু শঙ্খচুড় বললেন বিনা যুদ্ধে সে কিছুতেই স্বর্গ ফেরত দেবে না| চিত্ররথ অগত্যা ফিরে গিয়ে শিবকে সে কথাই জানালো|
শঙ্খচুড়ের এই স্পর্ধায় শিব ক্রুদ্ধ হয়ে নিজের সেনাকূলকে নিয়ে যুদ্ধে অবতীর্ণ হলেন| শঙ্খচুড়ও আপন সেনা নিয়ে মহাদেবের সাথে যুদ্ধে রত হলেন| সে এক বিষম যুদ্ধ চলতে লাগল দীর্ঘদিন ধরে| শঙ্খচুড় অজেয় ছিলেন তাই শিবের পক্ষে তাকে কিছুতেই পরাজিত করা সম্ভব হচ্ছিল না|
ক্রুদ্ধ‚ ক্লান্ত- পরিশ্রান্ত শিব অবশেষে তার ত্রিশুল নিয়ে যেই শঙ্খচুড়কে হত্যা করতে উদ্যত হলেন এক আকাশবাণী হল‚ যতক্ষণ শঙ্খচুড়ের হাতে শ্রী হরির কবচ কুন্ডল থাকবে ও তুলসীর সতীত্ব অখন্ড থাকবে ততক্ষণ শঙ্খচুড় অবধ্য|
শ্রী বিষ্ণু অতঃপর বৃদ্ধ ব্রাহ্মণের বেশ ধরে শঙ্খচুড়ের কাছে কবচ-কুন্ডল চাইলে তিনি তা নিসংকোচে দিয়ে দেন| এবার শ্রী হরির তুলসীর কাছে ছলতে যান শঙ্খচুড়ের রুপ ধারণ করে|
বহুদিন পরে তুলসী স্বামীকে রাজভবনে দেখে আহ্লাদিত হয়| দেবতাদের বিরুদ্ধে শঙ্খচুড় জয়ী হয়েছেন এই সংবাদে তুলসী আনন্দিত হয়ে স্বামীকে বন্দনা করেন| বহুদিন পর স্বামীসঙ্গলাভ করেন| বিষ্ণুরুপী শ্রী হরির ছলনা ধরতে পারে না সে | তার সতীত্ব ভঙ্গ হয়| কবচ-কুন্ডলহীন অসহায় শঙ্খচুড়কে বধ করতে শিবের আর কোন অসুবিধা হয় না| শিবত্রিশুলেই শঙ্খচুড়রুপী সুদামার শাপমুক্তি ঘটে|
এদিকে তুলসী কিছুক্ষণ পরই বুঝতে পারেন ইনি তার স্বামী নন| শ্রীহরি নিজরুপে প্রকট হতেই তুলসী কান্নায় ভেঙ্গে পড়েন তার সতীত্বনাশ ও স্বামীর মৃত্যুর জন্য| একইসাথে ক্রোধান্বিত স্বরে বলে আপনি ভগবান হয়ে যে পাষাণ হৃদয়ের পরিচয় দিলেন‚ যেভাবে আমার সাথে ছল করলেন তার ফলস্বরুপ আমি আপনাকে অভিশাপ দিলাম আপনি ধরাতে পাষাণ হয়েই থাকবেন|
তুলসীর কথা শুনে মৃদু হেসে শ্রীহরি বললেন‚ তুলসী তুমি বিস্মৃত হয়েছ যে‚ বহুবর্ষ পূর্বে তুমি আমাকে প্রাপ্ত করার জন্য কঠোর তপস্যা করেছিলে| সেই তপস্যাবলেই এক্ষণে তুমি আমাকে প্রাপ্ত হলে| এই দেহ ত্যাগ করে তুমি দিব্যদেহ প্রাপ্ত হবে এবং আমার সাথে আনন্দে বিহার করবে| তোমার এই পার্থিব দেহ পবিত্র গন্ডকী নদীরুপে প্রবাহিত হবে এবং তুমি বৃক্ষমধ্যে শ্রেষ্ঠ তুলসীগাছে পরিণত হবে ও চিরদিন আমার প্রিয়া হয়েই থাকবে| আর আমি এই গন্ডকী নদী তীরে তোমার শাপে পাষাণ হয়ে বিরাজ করব যুগযুগব্যাপী| এই নদীমধ্যে বসবাসকারী কীটপতঙ্গরা আমার শরীরে দংশন করে আমার চক্র প্রতিষ্ঠা করবে যা আমার প্রতীকরুপে ধরাধামে চিহ্নিত হবে| পুণ্য অর্জনের উদ্দ্যেশে আসা জনগণ সেই শালগ্রাম শিলা আর তুলসীগাছের মধ্যে বিবাহদানের মাধ্যমে পুন্যার্জন করে অমৃতলোকে স্থান পাবে|

মন্তব্যসমূহ

এই ব্লগটি থেকে জনপ্রিয় পোস্টগুলি

শ্রীচৈতন্য মহাপ্রভু ও রামানন্দ রায় সংবাদ

  শ্ৰীরামানন্দ রায় রাজা শ্ৰী প্ৰতাপরুদ্রের অধীন পূৰ্ব্ব ও পশ্চিম গোদাবরীর বিশ্বস্ত শাসন কৰ্ত্তার পদে অধিষ্ঠিত ছিলেন। চৈতন্য মহাপ্ৰভু যখন দক্ষিণ দেশে যাত্ৰা করেন, শ্ৰীসাৰ্বভৌম আচার্য্য বিশেষ অনুরোধ করেন মহাপ্রভু যেন শ্ৰীরামানন্দ রায়ের সঙ্গে মিলিত হন । “তোমার সঙ্গে যোগ্য তেঁহো একজন, পৃথিবীতে রসিক ভক্ত নাহি তার সম''।।চৈঃচঃ মধ্যঃ শ্রীচৈতন্য মহাপ্ৰভু দক্ষিণ দেশ অভিমুখে যাত্ৰা করেন। হরিনামের প্রেম বিতরণ করতে করতে এলেন পশ্চিম গোদাবরীর তীরে । পন্ডিত সাৰ্ব্বভৌমের অনুরোধ অনুযায়ী শ্ৰীরামানন্দ রায়ের সঙ্গে মিলিত হবার ইচ্ছা মহাপ্ৰভুর মনে সদা জাগ্রত ছিল । শ্ৰীমহাপ্ৰভু গোদাবরীর মনোহর তটে এক বৃক্ষমূলে বসে আছেন । তার অঙ্গ কান্তিতে চতুৰ্দ্দিক যেন আলোকিত হচ্ছিল । এমন সময় অনতিদূরে রাজপথ দিয়ে স্নান করতে যাচ্ছেন শ্ৰীরামানন্দ রায়, সাথে বৈদিক ব্ৰাহ্মণগনের বিবিধ বাজনা । শ্ৰীরামানন্দ রায় দূর থেকে উপবিষ্ট বৃক্ষমুলে কান্তিযুক্ত সন্ন্যাসীবরকে একদৃষ্টিতে দৰ্শন করতে লাগলেন এবং মহাপ্ৰভুও তঁকে অপলক নেত্ৰে দেখতে লাগলেন । নয়নে নয়নে হল মিলন । তারপর শ্ৰীরামানন্দ পালকি থেকে নেমে শ্ৰীমহাপ্ৰভুর চরনে দন্ডবৎ ক...

কৃষ্ণ কোন ভক্তকে কীভাবে সাহায্য করেন?????

  কৃষ্ণ কোন ভক্তকে কীভাবে সাহায্য করেন ? প্রশ্ন : আমার প্রশ্নটি খুব তুচ্ছ, কিন্তু তবুও আমি জানতে চাই কীভাবে কৃষ্ণ কোন ভক্তকে সাহায্য করেন? শ্রীল জয়প তাকা স্বামী গুরুমহারাজ: কৃষ্ণ বিভিন্ন উপায়ে একজন ভক্তকে সাহায্য করতে পারেন। আমরা তাঁর অনুগ্রহের পন্থাগুলিকে পরিমাপ করতে পারি না। যেমন ধরুন, একটি মজার গল্প আছে। একটি বড় বন্যাকবলিত এলাকায় এক লোক ছিল। সে তার ঘরে গিয়ে বলত, হে ভগবান! আমাকে এই বিশাল বন্যা থেকে উদ্ধার কর। আর তখন একটি নৌকা এল, সে বলল, না না, আমি চাই কেবল ভগবান এসে আমাকে উদ্ধার করবে। এরপর হেলিকপ্টার এল। না, না, আমাকে কেবল ভগবানই উদ্ধার করবে। এমনকি যখন কৃষ্ণ যখন নিজে সেই ব্যক্তির সামনে উপস্থিত হলেন, সে বলল, তুমি কেন আমাকে আগে বাঁচাওনি? তিনি বললেন, আমি একটি নৌকা পাঠালাম, একটি হেলিকপ্টার পাঠালাম, তুমি আর কী চাও? তো এভাবে তিনি বাহ্যিকভাবে বা অভ্যন্তরীণ উপায়ে সহায়তা করতে পারেন। গীতায় বলা আছে কৃষ্ণ জ্ঞান, স্মৃতি ও বিস্মৃতি দান করেন। সুতরাং তিনি আমাদের সংশয়ও নাশ করেন। ~শ্রীল জয়পতাকা স্বামী গুরুমহারাজ ২৪শে জুলাই, ২০১৮ চেন্নাই, ভারত

মহান বৈষ্ণব আচার্য শ্রীল ভক্তিসিদ্ধান্ত সরস্বতী ঠাকুরের তিরোধান তিথি

২৬/১২/২০১৮ মহান বৈষ্ণব আচার্য শ্রীল ভক্তিসিদ্ধান্ত সরস্বতী ঠাকুরের তিরোধান তিথিতে গৌড়িয় সিংহপুরুষখ্যাত এই মহান আচার্যের জীবনী জানার জন্য পড়ুন নিচের বিশেষ লেখাটি শ্রীচৈতন্য মহাপ্রভু যৌবনে মাত্র ৪৮ বছর বয়সে জগত থেকে অন্তর্হিত হন। যদিও তাঁর পার্ষদ এবং দৃঢ়চেতা পরম্পরা আচার্যগণ, মহান বৈষ্ণবগণ এই অভিযান এগিয়ে নিয়ে গেছেন, কিন্তু একসময় কিছুকাল পরে মহাপ্রভুর সংকীর্তন আন্দোলন অন্তর্হিত হয়। মহাপ্রভুর শিক্ষা, মহাপ্রভুর নিদের্শনা এবং মহাপ্রভুর ধাম এই জগৎ থেকে অন্তর্হিত হয় এবং তদস্থলে সকল অপসম্প্রদায় গুলো আবির্ভূত হয়ে এমন শিক্ষার বিস্তার ঘটালো যা সম্পূর্ণরূপে মহাপ্রভুর শিক্ষার বিপরীত। শ্রীচৈতন্য মহাপ্রভুর শিক্ষা সম্পূর্ণরূপে পবিত্র ধর্মের নীতির ভিত্তিতে গঠিত, কিন্তু তাদের সেই ক্রিয়াকর্মগুলো ছিল সম্পূর্ণ অধার্মিক। এটি কলিযুগের আরেকটি চরিত্র। এই যুগ অধর্মের, তাই অধর্মীয় নীতিসমূহের ব্যাপক প্রসার ঘটবে এবং ধার্মিক নীতিসমূহ উপেক্ষিত হবে। শ্রীচৈতন্য মহাপ্রভুর অন্তর্ধানের পরে তা ঘটেছিল। অল্পকথায় বলতে গেলে, তাঁরা চৈতন্য মহাপ্রভুর নামে ধর্মের স্তম্ভস্বরূপ ৪টি বিধিনিষেধ ভঙ্গ ...